একাদশীতে কেন উপবাস করতে হয়? সত্যিই কি আপনার জীবন পরিবর্তন করতে পারে এই অদ্ভুত একাদশী ব্রত — VedicVoyage

0

একাদশীতে কেন উপবাস করতে হয়?

Ekhadoshi_image_vedicvoyage
একাদশী কি (What is Ekhadoshi)

একাদশী কি? এখন এই প্রশ্নের উত্তর আমরা খুব সহজভাবে দেওয়ার চেষ্টা করব। একাদশী হল একটি চাঁদের তিথি। আপনারা জানেন চাঁদের দুটি পক্ষ এবং এবং ১৫ টি তিথি আছে।
চাঁদের এই দুটি পক্ষ হল- ক. কৃষ্ণপক্ষ এবং খ. শুক্লপক্ষ। আর তিথি গুলো হল যথা- প্রতিপদ, দ্বিতীয়া, তৃতীয়া, চতুর্থী, পঞ্চমী, ষন্ঠী, সপ্তনী, অষ্টমী, নবমী, দশমী, একাদশী, দ্বাদশী, ত্রয়োদশী, চতুর্দশী এবং পূর্ণিমা অথবা অমাবশ্যা।
চাঁদের গতিপথের অমাবস্যার পরে পূর্ণিমা পর্যন্ত সয়কালকে শুক্লপক্ষ বলে আর পূর্ণিমার পরে অমবস্যা পর্যন্ত সময়কালকে কৃষ্ণ পক্ষ বলে। চাঁদের এই দুই পক্ষের অথাৎ কৃষ্ণপক্ষ এবং শুরুপক্ষ, হয়। তাই হিন্দুধর্মালম্বী মানুষের কাছে নিরম্বু উপবাস বিহিত একাদশীর ব্রত অবশ্য পালনীয় কর্তব্যের মধ্যে পড়ে।
উভয় পক্ষের একাদশী তিথিটিকে হিন্দু ধর্মে বিশেষ পুন্য অর্জনের দিন বলে মনে করা


কিছু প্রশ্ন - ❓ —> সত্যিই কি আপনার জীবন পরিবর্তন করতে পারে এই অদ্ভুত একাদশী ব্রত? একাদশীর আবির্ভাব কিভাবে হয়েছিল?  একাদশী ব্রত করলে কি লাভ? একাদশী কেন করবেন? কিভাবে করবেন? পাপপুরুষ কে?

➤চলুন একাদশী ব্রতের মাহাত্য বর্ননা করছি–

পদ্মপুরাণে একাদশী প্রসঙ্গে বলা হয়েছে। একসময় জৈমিনি ঋষি তার গুরুদেব মহর্ষি ব্যাসদেবকে জিজ্ঞেস করলেন, হে গুরুদেব! একাদশী কী? একাদশীতে কেন উপবাস করতে হয়? একাদশী ব্রত করলে কী লাভ? একাদশী ব্রত না করলে কী ক্ষতি? এসব বিষয়ে আপনি দয়া করে বলুন।

জৈমিনি ঋষি কে?

জৈমিনি ঋষি একজন প্রাচীন ভারতীয় ঋষি ও ধার্মিক গুরু ছিলেন। তিনি ভারতীয় দার্শনিক শ্রুতি দর্শনের মধ্যে একজন ছিলেন এবং তার নাম মুখ্যভাবে "জৈমিনি" দ্বারা পরিচিত হয়েছে। জৈমিনি ঋষি ব্যাকরণ শাস্ত্রে প্রসিদ্ধ ছিলেন এবং মিমাংসা দর্শনের একজন প্রমুখ আচার্য ছিলেন।

মহর্ষি ব্যাসদেব কে?

মহর্ষি ব্যাসদেব হলেন একজন প্রাচীন ভারতীয় ঋষি ও প্রতিষ্ঠাতা গুরু। তিনি ভারতীয় সাংস্কৃতিক এবং ধার্মিক পরম্পরার মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একজন ব্যক্তি ছিলেন। ব্যাসদেব মহর্ষি অনেক গ্রন্থ লেখেন এবং সংস্কৃত ভাষার নির্মাতা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ব্যাসদেব মহর্ষির লেখা "মহাভারত" একটি অত্যন্ত প্রসিদ্ধ মহাকাব্য, যা হিন্দু পুরাণিক কাহিনী এবং ধার্মিক বৈদ্যুতিকে বিস্তারিত বর্ণনা করে। এছাড়া, ব্যাসদেব মহর্ষি প্রমুখ ধর্মগ্রন্থ "ভগবদ্গীতা" এবং "ব্রহ্মসূত্র" লেখেন, যা হিন্দু ধর্মের গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থগুলি। ব্যাসদেব মহর্ষির অসীম জ্ঞান এবং বৈদিক শিক্ষার প্রতি অগ্রদূত হিসেবে তিনি অত্যন্ত মহৎ ব্যক্তি ছিলেন এবং তার গ্রন্থগুলি আজও ধার্মিক ও দার্শনিক চর্চা এবং অধ্যয়নে ব্যবহৃত হচ্ছে।


মহর্ষি ব্যাসদেব তখন বলতে লাগলেন- সৃষ্টির প্রারম্ভে পরমেশ্বর ভগবান এই জড় সংসারে স্থাবর জঙ্গম সৃষ্টি করলেন।মর্ত্যলোকবাসী মানুষদের শাসনের জন্য একটি পাপপুরুষ নির্মাণ করলেন। সেই পাপপুরুষের অঙ্গগুলি বিভিন্ন পাপ দিয়েই নির্মিত করলেন। সেই পাপপুরুষের অঙ্গগুলি বিভিন্ন পাপ দিয়েই নির্মিত হলো।

পাপপুরুষের মাথাটি ব্রহ্মহত্যা পাপ দিয়ে, চক্ষুদুটি মদ্যপান, মুখ স্বর্ণ অপহরণ, দুই কর্ণ- গুরুপত্নী গমন, দুই নাসিকা- স্ত্রীহত্যা, দুই বাহু- গোহত্যা পাপ, গ্রীবা- ধন অপহরণ, গলদেশ- ভ্রুণহত্যা, বক্ষ- পরস্ত্রী-গমন, উদর- আত্মীয়স্বজন বধ, নাভি- শরণাগত বধ, কোমর- আত্মশ্লাঘা, দুই ঊরু- গুরুনিন্দা, শিশ্ন- কন্যা বিক্রি, মলদ্বার- গুপ্তকথা প্রকাশ পাপ, দুই পা- পিতৃহত্যা, শরীরের লোম- সমস্ত উপপাতক। এভাবে বিভিন্ন সমস্ত পাপ দ্বারা ভয়ঙ্কর পাপপুরুষ নির্মিত হলো।


পাপপুরুষের ভয়ঙ্কর রূপ দর্শন করে ভগবান শ্রীবিষ্ণু মর্তের মানবজাতির দুঃখমোচন করার কথা চিন্তা করতে লাগলেন। একদিন গরুড়ের পিঠে চড়ে ভগবান চললেন যমরাজের মন্দিরে। যমরাজ ভগবানকে উপযুক্ত স্বর্ণ সিংহাসনে বসিয়ে পাদ্য অর্ঘ্য ইত্যাদি দিয়ে যথাবিধি তাঁর পূজা করলেন।

যমরাজের সঙ্গে কথোপকথনকালে ভগবান শুনতে পেলেন দক্ষিণ দিক থেকে অসংখ্য জীবের আর্তক্রন্দন ধ্বনি। প্রশ্ন করলেন এ আর্তক্রন্দন কেন?

আর্তক্রন্দন অর্থ কি?

আর্তক্রন্দন" শব্দের অর্থ হলো অত্যন্ত ব্যথিত ও ক্রন্দন করা, অর্থাৎ বেশী কান্না করা বা দুঃখে কান্না করা। এটি অক্সিজেন বা আভা বা অন্য কোনো সাহায্যের অভাবে হয় যা মানুষের জীবনে ব্যক্তিগত দুঃখ বা প্রতিসাম্যের ফলাফলে ঘটতে পারে। "আর্তক্রন্দন" শব্দটি সাধারণভাবে কান্না বা বিশেষ কান্না দর্শায়।

যমরাজ বললেন, হে প্রভু, মর্তের পাপী মানুষেরা নিজ কর্মদোষে নরকযাতনা ভোগ করছে। সেই যাতনার আর্ত চীৎকার শোনা যাচ্ছে।

যন্ত্রণাকাতর পাপাচারী জীবদের দর্শন করে করুণাময় ভগবান চিন্তা করলেন আমিই সমস্ত প্রজা সৃষ্টি করেছি, আমার সামনেই ওরা কর্মদোষে দুষ্ট হয়ে নরক যাতনা ভোগ করছে, এখন আমিই এদের সদ্‌গতির ব্যবস্থা করব। 

ভগবান শ্রীহরি সেই পাপাচারীদের সামনে একাদশী তিথিরূপে এক দেবীমূর্তিতে প্রকাশিত হলেন। সেই পাপীদেরকে একাদশী ব্রত আচরণ করালেন। একাদশী ব্রতের ফলে তারা সর্বপাপ মুক্ত হয়ে তৎক্ষণাৎ বৈকুণ্ঠ ধামে গমন করল। 

বৈকুণ্ঠ কি? বৈকুণ্ঠে মানুষ কি করে?

হিন্দুধর্মে, বৈকুণ্ঠ (সংস্কৃত: वैकुण्ठ) বা বিষ্ণুলোক হলো ভগবান বিষ্ণু ও দেবী লক্ষ্মীর আবাস। বৈকুন্ঠের আরেক নাম বিষ্ণুলোক"বৈকুণ্ঠ" হলো হিন্দু ধর্মের একটি পরমলোক বা স্বর্গের নাম। এটি হিন্দু ধর্মে ভগবান বিষ্ণুর স্বর্গীয় নিবাসস্থান হিসেবে পরিচিত। বৈকুণ্ঠ পরমলোকে সুখের এবং প্রশান্তির আবাস মনোনিবেশ করে থাকেন ভগবান বিষ্ণু ও তার দেবী লক্ষ্মী। বৈকুণ্ঠের স্বভাব অত্যন্ত দিব্যময় এবং প্রশান্ত, এবং সবচেয়ে উচ্চ আনন্দের অবস্থান হিসেবে বর্ণিত হয়।

শ্রীব্যাসদেব বললেন, হে জৈমিনি! শ্রীহরির প্রকাশ এই একাদশী সমস্ত সুকর্মের মধ্যে শ্রেষ্ঠ এবং সমস্ত ব্রতের মধ্যে উত্তম ব্রত।

কিছুদিন পরে ভগবানের সৃষ্ট পাপপুরুষ এসে শ্রীহরির কাছে করজোড়ে কাতর প্রার্থনা জানাতে লাগল- হে ভগবান! আমিও আপনার প্রজা। আমাকে যারা আশ্রয় করে থাকে, তাদের কর্ম অনুযায়ী তাদের দুঃখ দান করাই আমার কাজ ছিল। কিন্তু সম্প্রতি একাদশীর প্রভাবে আমি কিছুই করতে পারছি না, বরং ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছি। কেননা একাদশী ব্রতের ফলে প্রায় সব পাপাচারীরা বৈকুণ্ঠের বাসিন্দা হয়ে যাচ্ছে। হে ভগবান, এখন আমার কী হবে?

আরও পড়ুন: শ্রীকৃষ্ণের বাণী-০১ | সব সময়ে ফিরে আসা একটি উপহারের গল্প

আমি কাকে আশ্রয় করে থাকব? সবাই যদি বৈকুণ্ঠে চলে যায়, তবে এই মর্ত্য জগতের কী হবে? আপনি বা কার সঙ্গে এই মর্ত্যে ক্রীড়া করবেন?

পাপপুরুষ প্রার্থনা করতে লাগল হে ভগবান, যদি আপনার এই সৃষ্ট বিশ্বে ক্রীড়া করবার ইচ্ছা থাকে তবে, আমার দুঃখ দূর করুন। একাদশী তিথির ভয় থেকে আমাকে রক্ষা করুন। হে কৈটভনাশন, আমি একমাত্র একাদশীর ভয়ে ভীত হয়ে পলায়ন করছি। মানুষ, পশুপাখি, কীটপতঙ্গ, জল-স্থল, বন-প্রান্তর, পর্বত-সমুদ্র, বৃক্ষ, নদী, স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল সর্বত্রই আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করেছি, কিন্তু একাদশীর প্রভাবে কোথাও নির্ভয় স্থান পাচ্ছি না দেখে আজ আপনার শরণাপন্ন হয়েছি। 

কৈটভনাশন কি? কৈটভনাশন কাকে ডাকা হয়?

"কৈটভনাশন" হলো হিন্দু ধর্মে ভগবান বিষ্ণুর একটি প্রতীত রূপ বা মূর্তি। এই রূপে ভগবান বিষ্ণু সমুদ্রে তৈরি হন্তে পর্যন্ত একটি মহাবলোকে সৃষ্টির প্রারম্ভে বসতে থাকেন। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, ও মহেশ্বর হিসেবে এই মূর্তি হিন্দু ত্রিমূর্তির একটি অংশ হয়।
"কৈটভনাশন" শব্দটি বাংলা ও সংস্কৃত ভাষায় ব্যবহৃত হয়, এবং এটি ভগবান বিষ্ণুর একটি বিশেষ মূর্তির নাম হলো যা সমুদ্রমন্থন কর্মক্রমে তৈরি হয়। সমুদ্রমন্থন একটি প্রাচীন পুরাণিক কাহিনী, যেখানে দেবতা ও দানব সম্মিলিত হয়ে সমুদ্র মন্থন করে অমৃত প্রাপ্তির জন্য প্রয়াস করে। কৈটভনাশন এই সমুদ্রমন্থনে আমৃতের প্রতীক হিসেবে প্রকট হন এবং এই মূর্তি পূজা ও উপাসনার একটি অংশ হিসেবে পরিচিত।

হে ভগবান, এখন দেখছি, আপনার সৃষ্ট অনন্ত কোটি ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে একাদশীই প্রাধান্য লাভ করেছে, সেজন্য আমি কোথাও আশ্রয় পেতে পারছি না। আপনি কৃপা করে আমাকে একটি নির্ভয় স্থান প্রদান করুন।

পাপপুরুষের প্রার্থনা শুনে ভগবান শ্রীহরি বলতে লাগলেন হে পাপপুরুষ! তুমি দুঃখ করো না। যখন একাদশী তিথি এ ত্রিভুবনকে পবিত্র করতে আবির্ভূত হবে, তখন তুমি অন্ন ও রবিশস্য মধ্যে আশ্রয় গ্রহণ করবে। 

তাহলে আমার মূর্তি একাদশী তোমাকে বধ করতে পারবে না।

"এজন্যই তাই শুধু একাদশী ব্রত রাখলেই সমস্ত পাপ দূর হবে না তার জন্য ব্রতের সকল সঠিক নিয়ম মেনে পালন করতে হবে "।

এখন তাহলে  প্রশ্ন -❓  হল ☞

একাদশী ব্রত কিভাবে সঠিক নিয়ম মেনে পালন করবেন?

➤ চলুন জেনে নিই—

✪ একাদশী পালনের সাত্ত্বিক নিয়মগুলো হলো:

  1. সমর্থপক্ষে দশমীতে একাহার, একাদশীতে নিরাহার, ও দ্বাদশীতে একাহার।
  2. অসমর্থপক্ষে শুধুমাত্র একাদশীতে অনাহার।
  3. এছাড়াও, একাদশীতে পঞ্চ রবিশস্য বর্জন করে ফলমূলাদি অনুকল্প গ্রহণ।

✪ নিষিদ্ধ রবিশস্য

নিন্মে নিষিদ্ধ রবিশস্যসমূহ উল্লেখ করা হলো:
  1. ধানজাতীয় সকল প্রকার খাদ্য যেমন – চাউল, মুড়ি, চিড়া, সুজি, পায়েস, খিচুড়ি, চালের পিঠা, খৈ ইত্যাদি।
  2. গমজাতীয় সকল প্রকার খাদ্য যেমন – আটা, ময়দা, সুজি, বেকারির রুটি বা সকল প্রকার বিস্কুট, হরলিক্স ইত্যাদি।
  3. যব বা ভুট্টাজাতীয় সকল প্রকার খাদ্য যেমন — ছাতু, খই, রুটি ইত্যাদি।
  4. ডালজাতীয় সকল প্রকার খাদ্য যেমন — মুগ, মাসকলাই, খেসারি, মসুরি, ছোলা, অড়হর, ফেলন, মটরশুঁটি, বরবটি ও সিম ইত্যাদি।
  5. সরিষার তেল, সয়াবিন তেল, তিলের তেল ইত্যাদি। উপর্যুক্ত পঞ্চ রবিশস্যের যেকোন একটি একাদশীতে গ্রহণ করলে ব্রত নষ্ট হয়।

✪ সতর্কতা

  • একাদশীতে শরীরে প্রসাধনী ব্যবহার নিষিদ্ধ।
  • সকল প্রকার ক্ষৌরকর্ম নিষিদ্ধ।
এভাবে উপরের উল্লেখিত নিয়মাবলি অনুসরণ করে ব্রত পালনের মাধ্যমে আপনি আপনার কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পাবেন।

এই ব্লগপোস্টে আমি হিন্দুদের একাদশী ব্রত পালনের ইতিহাস এবং এই ব্রত পালনের নিয়মাবলি তুলে ধরেছি। ভুল ও ত্রুটি গুলো ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন 🙏 এবং এ সম্পর্কে নিচের কমেন্টের মাধ্যমে আপনার মতামত জানাতে পারবেন। ধন্যবাদ 💟, এতক্ষণ সময় দিয়ে পড়ার জন্য। আমাদের ফেসবুক ফেইজ ও গ্রুপে যুক্ত হওয়ার অনুরোধ রইল।

  
সম্পাদনায়: ধ্রুব দাশ (সিইও) 
প্রযোজনা: VedicVoyage
অন্যান্য সহযোগিতায়: ChatGPT, Wikipedia


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)